অবশেষে
ভীষ্মদেব সূত্রধর
লিখবার কল্পনা বাসনা ছিলনা, মস্ত গপ্প লিখবো, তা কি করে হয় জানিনে, কি করে প্লট সাজাতে হয়, চরিত্র বসাতে আমাকে ভীষণ কষ্ট লাগে, সংলাপে জড়তা,বর্ণনায় ক্লান্তি,নিথর তো আর গল্প হয় না।যদিও জাত লিখিয়ে নই,আমার পিতা ষোল আনা পড়াশোনা করেছিলেন,হাত হতে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট ফসল তিনি ফলিয়েছিলেন,কিন্তু সাংসারিক ডামাডোলে সবটাই বৃথা গেছে।আমার পিতামহ কোনো রকমে বিদ্যে গিলে পিতৃশোকে তা বন্ধ করে ভবঘুরে হয়েছিলেন,সুর করে মহাভারত রামায়ণ পড়তে পারতেন,দু চার লাইন সাধু ভাষায় চিঠি তো লিখতে পারতেন বেশ,যদিও রীতির কোনো ভালভালাই নেই,তার পিতা অর্থাৎ আমার প্রপিতামহ নাম সইয়ের অনন্যতা জানতেন,যেহেতু উনি একজন শিল্পি ছিলেন।
বেশি বকেছি এমন অভিযোগ তো নেই, একটি ফেরবার গল্প বলি, কিন্তু কী? থাক।
সকালে বৃষ্টি হয়েছিল, মাটি থেকে ভাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে, আমার চোখে ভীষণ কাতরতা, চোখ ঘোষে কোনো রকমে বিছানা ছেড়ে উঠি, বড্ড আলসেমি, দাঁতের উপর অত্যাচার চালিয়ে বেরোই, পেট চো চো করছে, ফুটপাত ফাকা,চায়ের দোকানী গালে হাত দিয়ে বসে আছে, কি যেন ভাবছে,জাগাবার ইচ্ছে নেই,কলা পেটিস গিলে দাম চুকিয়ে দিলেই পারি,খিদে খুব অদ্ভুত!
অদ্ভুত সবই, সবাই, যেমন ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে যাচ্ছে সমস্ত রঙিন, আগ বেলা সুপ্তি এক রাশ হাসি দিয়ে বলল, "কাল যে ঘন ঘন বিড়ম্বনায় ফেলছে না!
-কেন,কী হলো?
-এইটুকু উপটান দাম কি জানো?
-না, কিনিনি কখনো
-কিনবে কি!
-আর কী কিনলে?
-বলা যাবে না।
-কেন?
-এমনি।
না, জানতে চাইনা, কোল ঘেষে ব্যক্তি পর্যায়ে চলে যায়, এ হেন অপরাধ, তার উপর কৈফিয়ত!
তবুও জানিনা কি যেন বাঁধে, কলার বেয়ে ঘাম চুইয়ে পড়ছে, শার্ট ভিজে একাকার, টান্সপারেন্স মনে হচ্ছে,বুকের পশমগুলো কুঁকরে গেছে,চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতেই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল, আমি থামাতে পারিনা, বললাম,"কোথায় যাচ্ছি?"
বলল,"যেখানে যেতে ইচ্ছে করে।"
তারপর নিঃশব্দে এগোচ্ছি।
মাঝে মাঝে খুব রাজনৈতিক মনে হয়, শুধু সুবোধ বালকের মতো রীতি অনুশাসন মেনে চল,এও কি হয়!আমি বোধয় একে কখনো স্বাধীন বোধ করিনি,ওর সাদা কালো চৈত্র পোশাক ভয়ানক স্পৃহা জন্মায়, কোনোদিন গাল ছুয়ে দেখিনি,ঠোঁট কেঁপে উঠেছে,কিসের জন্মান্তর,কিসের বাকপ্রণালি, কিসের তৈলচিত্র, আমাকে সত্যি নির্বোধ মনে হয়। রাস্তায় দাড়ানো মানুষগুলো কান্ড দেখছে, হাসছে, আরো কি বলছে, তাতে কিছু যায় আসে না, পিতার অর্থভান্ডার শেষ হল বৈকি,আমি তবু হাত পেতে ভিখ মাঙি,মা বলতেন,"এখনে কি হাত চালাও?"
থাক। আমি কুন্ঠাবোধ করিনা, গর্ভের উপর ঋণী, আমার ঋণ খসাতেই বুক জ্বলে, মায়ের নয়, তার!
রিকশায় চেপে কোথায় পৌছে গেছি জানিনা, আমি তাকিয়ে ছিলাম,তার চোখ মুখে অস্পষ্টতা, গাঢ় হলো আমার হৃদয়পিঞ্জিরা।
বলল, "নামো..।
আমি সম্বিৎ ফিরে বললাম, "হুম।"
গাছের আগায় লাল আগুন, পাখি দুটি ঝগড়া করছে অবিরত, কি বলছে!হয়তো সংসার বলে তাদেরও অস্থিরতা, কি যেন মিনসের গলা নিভে যাচ্ছে, বুঝলাম না।
লোহার আরাম কেদারা, বসে পা ছড়িয়ে দিই, সুপ্তি হাত ধরে আঙুল নাড়াচারা করছে, কিছুক্ষণ স্তব্ধ, নিরবে বয়ে চলছে স্রোত, তারপর বলল, "তুমি জানো, আকাশে আজ তোমার আমার নাম খোদাই করবো!"
অসীমে কি করে খোদাই করা যায় তাই ভাবছি, মিথ্যে।
-হুম
-ছেলে হলে নাম রাখবো রুদ্রদেব।
-কার?
-আমাদের!
আমি চমকে উঠলাম, আমি তো এমন কোনো কথা দিইনি, বরং চেয়েছি মুক্ত বিহঙ্গের মতো....
উত্তর শুনে হয়তো কষ্ট পেল, আনত চোখে বলল, "আমি কি বেশি ভেবে নিয়েছি? তাহলে থাক।"
চায়ের পর সিগারেট টানবার অভ্যেস, মনযোগী হতে হতে চাইছি, নিপাট ভদ্দর লোক, ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম ভদ্দর লোক সম্পর্কিত আর্টিকেল, ফুলের গন্ধ ভাসছে, নিশ্বাসে ভরে নিই যতটুকু পারা যায়, মডার্ন প্রোজে কিছু ভাল লাগার মতো লেখা ছিল, বারট্রান্ড রাসেল, তাঁর লেখাটি বেশ।
পাখি দুটো আর নেই, আধার খুজতে সয়ে রয়ে চলেছে, মানুষে বলে ওটা অভ্যেস, আমি বলি বদভ্যেস, আমি কী গুহাবাসী তরুণ? আমি কী নব্য রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করছি? সংবিধান?
সবটাই গোছানো মৃত্যু ফাঁদ। স্বৈরতা।
শহর ছেড়ে কিলো পাঁচ উত্তরে, তবুও বাস, ট্রাক, অটো বাইপাস রুট হিসেবে কাজ সারছে, গন্তব্যে পৌছানোই স্বার্থকতা নয়।বাতাসের কোনো পাত্তা নেই, আমি ঘামছি, সুপ্তি বলল,"বাদাম খাই?"
-হুম। চলে।
বাদামঅলা চোখ টিপে বলল, "মামা লন খাঁটি বাদাম, খাইবেন মজা লইবেন।"
-বাদামের খাঁটি কী? সোনা নাকি যে খাদ মিশানো আছে।
বাদামঅলা চলে গেল,সুপ্তি ফিক করে হাসল,আকাশে সূর্যের রীতিমতো দূর্ব্যবহার, গাছের তলায় বসে পারতাম, জাহির করলে, বলল,"লোকে খারাপ ভাববে,আড়ালে আবডালে...হুম।"
-অ্যাঁ।
সেদিন চূড়ান্ত অভিনয়, কাটিয়েছি মিথ্যের মধ্য দিয়ে, পৃথিবীতে এটাও প্রথা, ওসব শুধু কামদায়ক, মনকষ্ট বলতে যা থাকে তা আপনার ব্যর্থতায়, প্রেমে নয়।
একটি পরাধীন এবং সাজানো কৌতুক।
তবে হাসির বদলে বিড়ম্বনাই সইতে হয় বেশি।
তারপর এক সন্ধ্যায় বেলকোনীতে দাড়িয়ে বাতাসের সাথে সঙ্গম করছি, ম্যাজিক বস্তুটিতে স্মরণ নামক অনুভূতি মানসিকতার সাথে জুরে দেয়া আছে,তাই বোতাম টিপে কন্ঠ পৌছানোর পায়তারা করছি,বার বার,ডুবে গেছি, বিকেলে গেটের সামনে দাড় করিয়ে আর ফিরে আসেনি, বলতে পারতে, আমি বেরোচ্ছিনা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তবু অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চলে এলাম, বস্তুটি বন্ধ ঘোষণা করলো, আমি একটু ঢেলে সাজিয়ে বলতে পারি, ভালবাসার বিস্তর অর্থ আছে, কাম আছে,বেদনা আছে,য দি সেটি ভালবাসা হয়, কেমন, একটু খোজ, একটু আদরযত্ন, একটু অধিকার,একটু সমর্পণ, একটু....
হায় সব অবশেষে বিষ পান।
আমি রাজপথে হাঁটলে বুঝি, মানুষ কত অসুখে ভুগছে, ক্যান্সার, এইডস, গোদ ইত্যাদি কিছু নয়, মানসিক অসুস্থতাই চরম বিপাকে ফেলে দেয়, তখন বাঁচবার মানে মৃত্যু গ্রহণ করি।
পিতা সাবধান বার্তা দিলেন,"অর্থ ভান্ডারে যে ক'টি টাকা আছে,তা দিয়ে সংসার চলবে,অন্যকিছুর উপায় দেখিনা।"
আমি বলদা, কাগজে কলমে হিতৈষিপণা দেখিয়েছি,আপন পকেটে যৎসামান্য ঢোকে,ছাত্রের মাথায় গলায় পাড়া দিয়ে, চলে,চলবেই বা না কেন? আমি বাউন্ডুলে বলে আরসবেরা চলছে না!আবার সেই কল্পিত কথা,বাস্তবে সব কড়ায় গন্ডায় হিসেব লয়।
একমাস চলে গেছে, সেদিন আর সেদিন নেই, সে রঙের ঘুড়িতে আকাশ ফুঁড়ে চলেছে,এটা তার স্বপ্ন, আমি স্বপ্নকে স্বাগত জানাই।
আমি কিছুই জানিনা, এখন সন্তানটির নামকরণে দেব টুকু ছেঁটে ফেললে ভাল লাগে। নইলে ঐ ইতিহাস পেঁচিয়ে ধরে। আমি সিগারেট জ্বালাই সময়ের বর্তমানে....
অণুগল্প
চাপাও ওস্তাদ, চাপাও
আবদুল বাতেন
কে একজন আসাদের হাতঘড়িটা খুব দ্রুত খুলে নেয়। ওমিগা ব্রান্ডের ঘড়িটা তাঁর খুব প্রিয়, সুইডেন থেকে বন্ধু মিঠুর পাঠানো। সে প্রাণপণে চোখ খোলার চেষ্টা করে।কিন্তু কোনভাবে খুলতে পারেনা।কে যেন তাঁর দু’চোখের পাতা সেলাই করে দিয়েছে। কিংবা তাঁর দু’চোখে আস্ত যুগল পাহাড় বসিয়ে রেখেছে।ঘড়িটা পকেটে রেখে লোকটা আসাদের ওয়েডিং রিংটা খোলার জন্য উঠে পড়ে লাগে।একবার ডানে আরেকবার বায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেনেটুনে বের করার নানা কসরত চালিয়ে যায়।আসাদের ভেতরটা ভেঙেচুরে যেতে থাকে।তাঁর শিরা উপশিরাগুলো পটাপট ছিঁড়তে থাকে।সে লোকটার পায়ে পড়ে বলতে চায় -প্লিজ, ওটা নেবেন না।ওটা আমার ওয়েডিং রিং, আমার বেহেস্তবাসী শ্বাশুড়িমার দেয়া প্রথম উপহার। কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে কোন অথপূর্ণ শব্দ বের হয়না। শুধু সামান্য অস্পষ্ট চিনচিন আওয়াজ ওঠে, পুকুরজলের বুদ্বুদ যেনবা। আসাদের মাথার ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরে। থুতনিটা তাঁর মুখের সাথে ঝুঁলে আছে, মনে হয়। জিভে বড় নোনতা নোনতা ঠেকে।দাঁতের অস্তিত্ব টের পায়না, সে।ডান পাটা ভয়ানক কনকন করে, কিন্তু নড়াতে পারেনা।একসময় খেয়াল করে, হাঁটু থেকে তাঁর বাঁ পাটা উধাও! সত্যি কি নেই? কেন ওটার অস্তিত্ব সে অনুভব করছেনা? দুমড়েমুচড়ে থাকা আসাদকে ঘিরে কয়েকটা মাছি উড়ে।ভনভন শব্দ হয়।উড়ে উড়ে একটা তাঁর নাকে বসে।নাকটা শিরশির করে চুলকায়।মাছিটাকে তাঁর লোকটার মত বদমাস বদমাস লাগে। লাল কি কালো পিঁপড়া তাঁর হাত বেয়ে উঠে। সে হাত নড়াতে চড়াতে পারেনা। হাত সরাবার সামান্য শক্তিও তাঁর আর অবশিষ্ট নেই। সে নিশ্চয় এখনো বেঁচে আছে। ধীর শ্বাসপ্রশ্বাসে তাঁর বুক উঠানামা করছে।যে বুকে আসাদ তাঁর মা, মেয়ে আর প্রিয়তমা স্ত্রীকে সযতনে রেখেছে। মানুষ মরে গেলে কি এতসব বুঝতে পারে? নিশ্চয় পারেনা।তাঁদের কোচটা ঠিকমত চলছিল, রাতের আঁধার চিরেফেঁড়ে।ইসলামি ওয়াজ ও সংগীতের ছোঁয়ায় ঝিমাচ্ছিল, নাইট কোচের সবাই। কায্বা নামায আদায় করছিল, মুরব্বীরা কেউ কেউ।আতরের সুঘ্রাণে ভেসে যাচ্ছিল আশেপাশের সিটসমূহ।আবার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে লতাজীর স্নিগ্ধ সুরের মূর্ছনায় সব ভিজে একাকার। অফিসের জরুরি কাজে দিনাজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিল, আসাদ।অনেকক্ষণ ধরে পিছনের কোচটা হর্ণ চাপিয়ে যাচ্ছিল, একনাগাড়ে।দুম করে সেটা তাঁদেরকে ওভার টেক করতে গেলে যাত্রীদের কেউ কেউ গা ঝারা দিয়ে ওঠে। সমস্বরে বাহাদুরি ফলাতে শুরু করে -চাপাও ওস্তাদ, চাপাও। ড্রাইভার সেই যে চাপাল, আসাদের আর কিছু মনে নেই।একটু একটু করে তাঁর কানে কোলাহল জড়ো হতে থাকে।কান্নাকাটির শব্দ তাঁকে আস্তে আস্তে জাগিয়ে তোলে। সে এখন তাঁর কাছাকাছি এ্যামবুলেন্সের সাইরেনে শিহরিত হয়। ভারী ভারী পায়ের আওয়াজে ভীষণ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
অণুগল্প
পৃথিবী
কোয়েল তালুকদার
যে ভালোবাসা দূরের, যার ব্যপ্তি বিশ্বলোক ছাড়িয়ে অপার্থিব অন্য কোনো ভূবনে বিরাজ করে। সেই ভালোবাসার জন্য বৈরাগ্য জীবনই শ্রেয়। পার্থিব অন্য আর কোনো মায়ায় জড়িয়ে যেতে নেই।' এই কথা গুলো বলছিল আয়ান হায়দার। আয়ান এসেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বাংলাদেশে। যাযাবরীয় জীবন তার। এখানে সে এসেছিল কোনো সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াতে। কিন্তু করেনি। এলোমেলো জীবন যেমন ছিল তেমনই নিয়ে সে আবার ফিরে যাচ্ছে।
আয়ান চলে যাচ্ছে। আমি জানি, ওর এলোমেলো জীবন আরও বেশি অগোছালো হয়ে যাবে। দুই দিন কর্মে থাকবে তো, তিন দিন ঘুরবে ভবঘুরের মতো। বরফ পড়া শীতের রাত্রিতে কোনো পর্বতের পাশে তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্প ফায়ার জ্বেলে উত্তাপ নিবে। ওর নিরুত্তাপ জীবনের উষ্ণতা খুঁজবে, তুষার পড়া রাত্রি দুপুরে।
ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এমনি এক শীতের রাত্রিতে লস এ্যাঞ্জেলসের ডাউন টাউনে একটি কফিশপের দোতলায়। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, পদ্মা যমুনা মেঘনা পাড়ের কেউ একজন হবে। আগ বাড়িয়ে আমিই পরিচিত হয়েছিলাম। বয়সে আমার তিন চার বছরের ছোট হবে। কিন্তু আমি ওর ক্ষণিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে।
আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে ওর সাথে কয়েকটি বিকেল কাটিয়েছিলাম প্যাসিফিকের তীরের লং বীচ, মালিবু ও সান্তা মনিকায়। এক রাত কাটিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। আর একদিন দুজনে সারারাত কাটিয়েছিলাম ডাউন টাউনের গ্র্যান্ড পার্কের বেঞ্চের উপরে।
মালিবু বিচের বালুকাবেলায় একদিন দুজন হাঁটছিলাম। আমাদের পিছনে ছিল পাহাড়। সামনে প্যাসিফিকের বিশাল জলরাশি। একদিকে নাম না জানা কতো লতাগুল্ম আর থোকা থোকা ফুলের ঝাড়, আর অন্যদিকে বিকালের লাল মেঘের আভা মিশ্রিত রুপালি জলের ঢেউ। কথা বলছিলাম আমরা সাগরের দিকে মুখ চেয়ে। কেন যেন মনে হলো, আয়ানের মুখ বিষন্ন মুখ ফিরে চেয়ে দেখি -- আয়ানের চোখের নীচে যেন প্যাসিফিকের নোনাজল। দেখলাম, মলিন হতশ্রী মুখচ্ছবি ওর। বিকালের রক্তিম সূর্যের রশ্মি সেই মুখকে একটুও রোশনি ছড়াতে পারেনি।
আমি আয়ানের পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, 'তুমি এমন একলা কেন? এখানে এই পরবাসে তোমার কেউ কী নেই? কদিনের দেখায় মনে হয়েছে, কোথায় কোন্ গভীরে, প্যাসিফিকের ঐ অতলান্তে তুমি তোমার অসীম কোনো দুঃখকে লুকিয়ে রেখেছ।' সেদিনের সেই নিমগ্ন সাগর বিকালে দূর হতে দমকা বাতাস বয়ে এসেছিল। আয়ানের এলমেল খুসকো চুল হাওয়া লেগে উড়ছিল। কিছুই বলতে চায়নি আয়ান, আবার বলতেও চেয়েছিল কী যেন কথা।
সেদিন মালিবু বীচের অপ্রসন্ন সেই বিকেলে কিছুই বলেনি আয়ান। বলেছিল আর একদিন ওর বাড়িতে। ওয়েল ডান কার্ণ কান্ট্রি এরিয়াতে নিরিবিলি ছোট্ট একটি রেন্ট বাড়িতে ও একাই থাকত। গ্রামীণ ছিমছাম একতলা বাড়ি। ঐদিন ঐ বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করেছিলাম। বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেই বারান্দায় বসে কথা বলেছিলাম। অনেক কথাই সেদিন হয়েছিল।
আয়ানের বাড়ির বারান্দায় বসে সন্ধ্যায় দেখেছিলাম পিছনে একপাশে টিউলিপ ফুলের প্রান্তর, আরেক পাশে লিলি। মাঝখানে মেঠো পথের দুপাশে কার্ণেশনের ঝাড়। আমরা বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন পিছনের প্রান্তর থেকে এইসব ফুলের গন্ধ আসছিল। রাত বেড়েই চলছিল। আয়ান আমাকে ওয়াইনের অফার করেছিল। আমি বললাম, না। শুধু সিগারেট। এ্যাস্ট্রেতে এক এক করে পোড়া সিগারেটের ছাই দিয়ে ভরে উঠছিল।
তখন ভালো লাগছিল ওয়েল ডান কান্ট্রির আকাশ। মনে হয়েছিল এ যেন বাংলাদেশের আকাশ! এ যেন আমাদের কুসুমপুরের তারাভরা রাত্রি। মাঝে মাঝে হিম প্রবাহ বয়ে আসছিল দূরের সান গ্যাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে। সেদিন তারার আকাশে কোনো কথা ছিল না। টিউলিপ ঝাড়ে কোনো জোনাকির গান নেই। বাতাসের কোনো শব্দ নেই। নিশ্চুপ ছিল নির্জন বিজন রাত। কী এক বিষাদ ছড়িয়ে সেদিন সেই রাতে আয়ান হায়দার বলেছিল তার কথা।
খুব সংক্ষেপিত করে আয়ানের মুখ থেকেই সে কথা শুনি:
মেয়েটির নাম ক্যাথেরিন রিচি। আমি ওকে ডাকতাম রিচি বলে। ও এসেছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে। রিচি ছিল একজন স্ট্রিপ গার্ল। প্যাসাডোনার নাইট ক্লাব ক্রেইক এ্যাভিনে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। নীল ঝলমলে আলোর নীচে আমি ওর বাঙালি মেয়েদের মতো কালো চোখ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। ওর ঐ চোখ দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। প্রথম কথা ছিল, 'তুমি কে? কোথা থেকে তুমি এসেছ। তোমার নাম কী?' তারপর বলেছিলাম, 'তোমার কথা কিছু বলো।' রিচি বলেছিল -- I am Katherine Ricci , came from Reo de Jenerio, Brazil. I am no bird, and no net ensnares me, I am a free human being with an independent will.'
রিচির কোনো ঘর ছিল না। পাখির বাসার মতো আশ্রম ছিল না। কিন্তু, সেই মেয়ে পাখির মতো নীল আকাশে উড়ত। রিচি বলেছিল -- 'আমি ধূসর কালো মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জলে ভিজি। রঙিন জলসায় পিয়ানো'র সুরে আমার অন্তরে বীণা বাজে। আমার দুঃখ নেই। আমার সমস্ত বেদনা সুখ হয়ে যায় মুহূর্তে সব নৈশ ক্লাবের আনন্দে।'
আয়ান একের পর এক সিগারেট শেষ করছিল। আমি বললাম, 'তারপর কী হলো? ঐ মেয়েকে তুমি কী ভালোবেসে ফেলেছিলে?'
আয়ান : জীবনের দুঃখতম নিয়তি ঈশ্বর মনে হয় নির্ধারিত করে রেখেছিল আমার জন্য। যে পাখির বাসা নেই। তার বাসা পৃথিবী জুড়ে নীল আকাশ। আমি রিচিকে এই ঘরে এনেছিলাম, বলেছিলাম-- এই ঘর তোমার। এখানেই তুমি তোমার সংসার বাঁধো। তোমাকে সন্তান দিব।
রিচির চোখ সত্যি বাঙালি। শাড়ি পরিয়েছিলাম ওকে বিয়ের রাত্রিতে। কী সৌভাগ্য! বাসর শয্যায় ওর ভ্রূণ তৈরি হলো। এক অনাগতের স্পন্দন ধ্বনি সেই রাতেই শোনা গেল।
আয়ান একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছিল। কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল বার বার। আমি বললাম -- তারপর ?
আয়ান : আমাদের সেই সন্তানটির পৃথিবীতে চলে আসবার দিন ক্ষণ খুব কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। উইলশেয়ার বেলেভার্ডের সামারিতান হাসপাতালে রিচির একটি চেকআপ ছিল। ডাঃ লী জয়নার ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়।
আয়ান আমাকে বলছিল, তুমি কী গান গাইতে পারো রঞ্জন? আমি বলেছিলাম -- ভালো পারি না।
--- তবুও শোনাও।
--- কী গান গাইব, বলো?
--- রবীন্দ্রনাথের গান।
--- কোন্ গানটি গাইব?
--- জীবন যখন শুকিয়ে যায়।
--- আচ্ছা, গাইছি।
অন্তরা পর্যন্ত গানটি আমি সেই দিন আয়ানকে গেয়ে শোনায়েছিলাম। শেষটুকু আর গাওয়া হয়নি। রাত তখন অনেক হয়ে গিয়েছিল। হিম বাতাস বয়ে আসছিল প্রবলবেগে। মনে হচ্ছিল, কার্নেশন, আর টিউলিপ ঝাড়ে জলের মতো বিন্দু বিন্দু করে তুষার ঝরে পড়ছে।
আমি আয়ান হায়দারকে বলি -- তারপর?
আয়ান : একদিন হাস্পাতালের বেডে শুয়ে থেকে রিচি আমাকে বলেছিল --- যদি দূরে চলে যাই। জীবনের ওপাড়ে যদি অন্য কোনো ভূবন থাকে, সেই ভূবনেও তুমি এসো।
কতো প্রহর, কতো ক্লান্তিতে পথ ধরে হাঁটছি। আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি ওর ভুবনে পৌঁছার। কিন্তু ওর সেই ভুবন ওর সেই পৃথিবী যে অনেক দূর!
অণুগল্প
গল্প নয় কাহিনি
ফিরোজা বেগম
আয়েশারা চার বোন। প্রত্যেকটা বোন দেখতে অসম্ভব সুন্দরী। কাছে বসে দেখলে মনে হয় "চকোরী" ছবির নায়িকা সেই ছোট্ট শাবানাকে দেখছি। তবে শাবানার চোখ ছোট আর চার বোনের চোখ যেনো টানা টানা কাজলনয়না । গায়ের রঙ দুধে হলুদে মিশ্রণে। জোড়া ভ্রু, গোলাপ পাপড়ি ভেজা ঠোঁট। এহেন রূপের অধিকারীনিরা আবার মেধা ও মননে সবার সামনে। স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসেবে বেশ পরিচিতা। গুণেও সবাইকে ছাড়িয়ে । বড়ো বোন রাইসা লেটার নিয়ে এস এস সি,এইচ এস সি পাশ করে ইউনিভার্সিটিতেও প্রথম শ্রেনী হাতে নিয়ে সাথে সাথেই শিক্ষা বিসিএস দিয়ে শিক্ষকতার মহান পেশাটি বেছে নিলো। সাথে সাথে ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথেই বৈবাহিক গাঁটছড়া বাঁধলো। এ যেনো পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার নিয়ে গেলো সুন্দরী রাজকুমারীকে। সুয়োরাণী হয়ে সামলাচ্ছে তার সাজানো সংসার। রয়ে গেলো মেজো রাজকুমারী।
মেজো রাজকুমারী আয়েশা ! রূপে গুণে শিক্ষায় বড়োকে আরো একধাপ ছাড়িয়ে গেলো। আয়েশা লেখাপড়ায় ক্লাশে তুখর ছাত্রী। প্রতিটি ক্লাশে প্রথম স্থানটি কেড়ে নিয়ে এস এস সি তে সর্বাধিক নাম্বার পেয়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে এইচ,এস,সিতে ভর্তি হয়। হোষ্টেলে থেকে পড়াশোনার সময় ভাগ্য বিড়ম্বনা করলো আয়েশার সাথে। ওর এতো সাফল্য রূপ আকৃষ্ট করলো সম্পর্কে না যাওয়া দেখতে সুন্দর এক যুবক আত্মীয় শাহীনকে। জড়িয়ে পড়লো অসম প্রেমে। এর বেলায় বোধহয় দুয়োরাণী শব্দটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। যুক্ত হতে থাকলো " অতি সুন্দরী না পায় বর আর অতি ঘরণী না পায় ঘর! " ওদের এই প্রেম মা বাবা আত্মীয় স্বজন কেউ মেনে নিতে পারলোনা। একদিন ওরা দু'জন কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ে করে সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলো। চোখের জলের বিনিময় যে সুখি হওয়া যায়না আমাদের দুয়োরাণী তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিলো।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুয়োরাণী আয়েশা মা হতে চললো। ব্রজমোহন কলেজের পাঠ চুকিয়ে বুকিয়ে শ্বশুর বাড়ির কাছাকাছি সরকারি কলেজে ভর্ত্তি হয়ে মাঝে মাঝে ক্লাশ করতে থাকলো। কলেজ, শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর দেখভাল করা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হলো। অপরদিকে প্রেগন্যান্সির কারণে নিজের শরীরটাও খুব দুর্বল লাগছিলো আয়েশার। যখন এমন কষ্টকর অবস্থা একদিন লুকিয়ে দ্বারস্থ হলো ওদের পারিবারিক পুরনো ভৃত্যের কাছে। তার একটি কিশোরী মেয়েকে কাজে সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানালো। পুরোনো ভৃত্য কোনো বাক্যব্যয় না করে তার মেয়েকে দিয়ে গেলো আয়েশার কাছে। মেয়েটি ভালোই দেখাশোনা করতে থাকে। রাতে মেয়েটিকে আয়েশা নিজে পড়ায়। ভাবে একটি মেয়ে যদি দারিদ্র্যতাকে জয় করে নিজের একটা সম্মানজনক পরিচিতি বানিয়ে নিতে পারে, ক্ষতি কি ?
যথাসময় আয়েশার কোলজুড়ে ফুটফুটে আর এক রাজ কুমারের আবির্ভাব হলো। কিন্তু ; নানা- নানীর কোনো আদর আপ্যায়ন থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলো। আয়েশার স্বামী বেকার। বাধ্য হয়ে নিজের ও সন্তানের ব্যয় মেটানোর জন্য বাড়িতেই বেশ কয়েকটি মেয়েকে টিউশানি পড়াতে থাকলো। তাতে করে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতে থাকে। আয়েশা স্বামী শাহীনকে উৎসাহ যোগাতে থাকে কোনো কাজের জন্য। কিন্তু অলসতা যেনো তার জীবনের ব্রত। এমনি পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে প্রেমের খেসারত দিয়ে যাচ্ছিলো আয়েশা ।এদিকে পড়ার চাপ বেড়ে গেলো। সামনে অনার্স ফাইনাল। তবুও টিউশানিকে ছাড়ছেনা। ওটা ছাড়লে চলবে কী করে? দেখতে দেখতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। আয়েশা ছেলেকে মুকুলী ও শ্বাশুরীর কাছে রেখে সকালে পরীক্ষা দিতে যায় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই একদিন বাসায় ফিরে দেখে মুকুলীকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সবাই খোঁজ খবর করছে। ওর বাবার কাছে মোবাইল করে জানতে পারে ওখানেও যায়নি। মহাবিপদে পড়লো গোটা পরিবার। স্বামীকে পাঠালো জানাশোনা কোথাও খোঁজ খবর নিতে। কোনো ছেলের সাথে প্রেম ছিলো কিনা এমন সব ভাবতে ভাবতে দুদিন পর শাহীন মুকুলীকে সাথে নিয়ে ফিরলো। সকলের প্রশ্ন কোথায় গিয়েছিলো মুকুলী ? কোথায় পেলে? ইত্যাদি! কিন্তু; শাহীন কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। মুকুলী ওড়নার আঁচলের এক কোণা মুখে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আয়েশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো সাঁই সাঁই করে দুটো চড় কষিয়ে দিলো গালে। সাথে সাথে ফুঁসে উঠলো মুকুলী, " খবরদার! আর একটা চড়ও দিবেনা আমায়। এবার আপনি থেকে তুমিতে চলে গেলো, তোমার এই সংসারে যে অধিকার, আমারও সেই একই অধিকার! " আয়েশা স্তব্ধ হয়ে গেলো। ধীর গতিতে রুমে ঢুকে শাহীনের সামনে দাঁড়ালো। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, " মুকুলী এসব কী বলছে? কেনো বলছে? এর জবাব দাও ! শাহীন নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয়, "তুমি তো একজন নারী বুঝতে পারছোনা? মুকুলী ঠিকই বলেছে। আমি মুকুলীকে ভালোবাসি। আয়েশার চোখে তিনটি বছরের ফেলে আসা অপমান,ব্যথা ও যাতনার দিনগুলো চোখের সামনে দ্রুতগতিতে ভেসে উঠলো আবার মিলিয়ে গেলো। চারিপাশে শুধু ধূ ধূ মরুভূমি দেখতে থাকে। কোথায় যাবে আয়েশা ছেলেকে নিয়ে। মা বাবা কি এই মুহূর্তে পাশে থাকবে? হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শাহীনের মু্খোমুখি হয়। তারপর শ্বশুর শ্বাশুরীর সামনেই শাহীনকেও শক্ত হাতে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে, "ভালোবাসা? আরে ভালোবাসার তুই কী বুঝিস? তুই তো আস্ত একটা চরিত্রহীন কা-পুরুষ! " এই বলে এক কাপড়ে ছেলের জামাকাপড় নিয়ে বের হয়ে আসে।
আয়েশার দু'চোখে অন্ধকার নেমে আসে। কোথায় যাবে ? কার কাছে গিয়ে দু'চোখের অশ্রু ঝরাবে। শ্বশুর শ্বাশুরী অবশ্য আয়েশার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু ; আয়েশা নির্বিকার। চোখদুটো জ্বালা করছে। কাঁদতে পারলে হয়তো একটু শান্ত হতো। কান্নারা কোথায় পালালো এই মুহূর্তে ? ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিলো। রাতটা কাটতে না কাটতেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বড়ো খালার বাসায় গিয়ে উঠলো। সেখান থেকেই এতো প্রতিকূলতার মধ্যে পরীক্ষা শেষ করলো। আর টিউশানি চালিয়ে মা ও ছেলের জীবন যাপন করতে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়েছিলো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল পেলো। তাতে আয়েশা সর্বপ্রথম হয়েছে। যথারীতি মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে চাকুরিতে যোগদান করলো। স্বামী পরিত্যাক্তা ও বয়স বিবেচনায় নিয়োগ কমিটি ওকে শহরের মধ্যেই একটি স্কুলে সহঃ শিক্ষিকা পদে নিয়োজিত করলো।
আয়েশার খালার বাসায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে একদিকে চাকুরি অন্যদিকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকলো। পাশাপাশি বিসিএস গাইড কিনে নিয়মিত পড়তে থাকে। অনার্স এর ফল বেড়োলো প্রথম বিভাগে প্রথম। আশার আলো চোখের তারায় চিকচিক করে উঠলো। পূর্ণ উদ্যমে আবার পড়াশুনা শুরু করলো আয়েশা। এবারে মাস্টার্স। তাতেও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলো। মাঝখানে বিসিএস( ক্যাডার ) প্রিলিমিনারি দিয়ে লিখিত পরীক্ষার দিন গুনছে আয়েশা।
আয়েশার চোখে রাতে ঘুম নেই। জেগে জেগে আগামী সাফল্যতার স্বপ্নে বিভোর থাকে আর দিনে তার সংগ্রাম চলে। সুন্দরী রূপসী সেই আয়েশাকে আর চেনা যায়না। গায়ের রঙ মলিন,মুখের হাসি বিলীন, পেটে ক্ষুধা, সমাজের কাছে লজ্জার জবাবদিহিতা করতে করতে যখন ক্লান্ত ঠিক সেই সময় বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হাজির। প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসে ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিলো। আয়েশার মনে হলো ইশ্বর সয়ং ওর কলমটা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র যেনো ওর কতোদিনের জানাশুনা। পরীক্ষার হল থেকে বেড়িয়ে আয়েশার মনে হলো নতুন এক সূর্য পূব আকাশ রাঙিয়ে উঁকি দিচ্ছে শুধু ওরই জন্য।
আজ সাত বছর হয়ে গেলো আয়েশা ১ম শ্রেণীর একজন বিসিএস ( প্রশাসন) এর কর্মকর্তা। সে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদমর্যাদায় চাকুরি করছে সাফল্যের সাথে। এর মধ্যে সহকারী কমিশনার, আরডিসি, সহকারী কমিশনার (ভূমি )'র দায়িত্ব পালন করে সচিবালয়ে কর্মরত আছে। এখন বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাই প্রশংসায় মুখর আয়েশার। সবাই খোঁজ খবর রাখছে।
এদিকে শাহীনকে ছেড়ে মুকুলী চলে গেছে এক রিক্সাওয়ালার হাত ধরে। ওখানে বিয়ে করেছে । শাহীন বাবা মাকে নিয়ে গিয়েছিলো আয়েশার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু ; আয়েশা তার প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্তে অটল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে শাহীন ও শ্বশুর শাশুড়িকে। আয়েশার ছেলে রাকিন ঢাকার নামকরা একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে।
আয়েশা এখন রূপে,গুণে, সাফল্যে সমাজে উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ছয়মাস আগে আয়েশার অফিসের সিনিয়র যারা,সবাই মিলে বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের পাত্র যদিও বিপত্নীক। প্রথম সন্তানের জন্মদিতে গিয়ে তিন বছর আগে স্ত্রী মারা যান। সতঃস্ফুর্ত ভাবে আয়েশার ছেলের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তিনি নিজেও বিসিএস ( প্রশাসন) এর যুগ্ম-সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। সবদিক বিবেচনায় এই বিয়েকে স্বাগত জানান সর্বস্তরের মানুষ।
শিক্ষনীয়ঃ নারী শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষার ফল খুবই মধুর। নারী সন্তানের জন্য ধৈর্য ও আত্মত্যাগের প্রতীক!
অণুগল্প
শুধুই গল্প
ফিরোজা সামাদ
বেশ কিছুক্ষন আনমনা হয়ে বসে থাকার পর ঘড়িতে ন'টা বাজার আওয়াজে ঘোর কাটলো রানু'র।বাইরের রাধাচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে আছে। গাছের নিচেও কে যেনো বিছিয়ে রেখেছে হলুদ রঙের গালিচা।দুটো শালিক পাখি ঘুরে বেরাচ্ছে ওই হলুদ গালিচার উপর আর খুঁটে খুঁটে কি যেনো খাচ্ছে। কি সুখের জীবন ওদের তাই না? রানুর ইচ্ছে করে পরজন্ম যদি থাকে তাহলে ও যেনো পাখি হয়েই জন্মায়। বাঁধন বিহীন জীবনে বাঁধন ছাড়া হয়ে যেখানে সেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারবে।ওড়ার কোনো সীমারেখা থাকবে না ওর ! দিনতিনেক আগে হঠাৎ করে ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পায় রানু।নামটা ভীষণ চেনা, শায়ন্ত । কিন্তু ;সেই ছোটোবেলার শায়ন্তের সাথে তো কোনো মিল নেই এই ফেসবুকের ভদ্রলোকের! সেই ছটফটে বেপরোয়া দামাল ছেলেটা কি করে এমন দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে গেল? কিছুতেই মেলাতে পারছিলো না রানু । শেষমেশ গ্রহন করল বন্ধুত্ব। সুদুর ইউরোপ থেকে আসা মুখছবির বন্ধুত্ব ! আজ সকালে ইনবক্সে নক করে শায়ন্ত।।কাঁপা কাঁপা হাতে " হ্যালো " লেখে রানু। কিন্তু ; ওর হাত কাঁপছে কেনো ? সেদিন কি সত্যিই কোনো অনুভূতিরা দাগ কাটেনি রানুর মনে? যেদিন শায়ন্ত ওর চোখে চোখ রেখে বলেছিলো ভীষন ভালোবাসি তোকে রানু! হাতে একটা নীল খাম ছিলো ওর, যেটা আর শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি রানুকে। শায়ন্তর অনুভূতিরা বন্দী রয়ে গিয়েছিলো ওই নীল খামে। সেদিন এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছিলো রানু । শায়ন্তকে হ্যা না কিছুই বলতে পারেনি সেদিন। হয়তো বলার চেষ্টাও করেনি। ফিরে যাওয়ার সময় রানুর কানে এসেছিলো শায়ন্তর বলা কথা,"অপেক্ষায় থাকবো রানু শুধু তোর অপেক্ষায়! " চৌদ্দ বছরের দুটি কিশোর কিশোরীর মন এরপর জড়িয়ে পরে যে যার নিজের জীবনে। কেটে গেছে দীর্ঘ বিশটা বছর। এর মাঝে রানু কোনোদিন কোনো খোঁজ করেনি শায়ন্ত নামের সেই ছেলেটির। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করে রানু আজ ঘোর সংসারী। নিজের হাতে গোছানো তার সংসার। পরিপাটি সুসজ্জিত। রানুর শরীরে ও মনে যেনো সুখের প্রলেপ মাখানো। তাও কেনো আজ এতো বছর পরে শায়ন্তকে "হ্যালো" লিখতে রানুর হাত কেঁপে উঠলো? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেনি রানু। কারণ, সবকিছুর উত্তর খুঁজতে নেই । কিছু উত্তর অজানা থাকাই ভালো। আজ অনেক কথা বলে ওরা দুজন । পুরোনো কথা, তাও কেমন যেনো নতুন লাগে রানুর কাছে।সেদিনের অনুভূতিরা গুটি পোকা থেকে প্রজাপতি হতে পারেনি রানুর জন্যই । তবে, নীল খামের ভেতরের অনুভূতিগুলো দম বন্ধ হয়ে মরে যায়নি এখোনো । শায়ন্ত আজও আগলে রেখেছে অনুভূতিগুলোকে। রানুর আজ ভীষনভাবে ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে হারিয়ে যাওয়া সেই অনুভূতিগুলোকে। জানতে ইচ্ছে করছে নীল খামের ভেতর বন্দী কথাগুলোর কথা। হাত বোলাতে ইচ্ছে করছে অক্ষর গুলোর উপর। হঠাৎ মেসেজ ঢোকার শব্দ। মোবাইল খুলতেই দেখা দিলো সেই নীল খাম। ছবি হয়ে ফুটে উঠল মোবাইল স্ক্রিনে । পুরোনো হয়ে গেছে অনেক, বিশ বছরের পুরোনো। ঔজ্বল্য হারিয়েছে চকচকে নীল রঙ। তারপর দেখা দিলো অনুভূতিরা। রানুর না নেওয়া প্রথম প্রেম পত্র। সুদুর ইউরোপ থেকে আসা শায়ন্তর অনুভূতিগুলো আনমনে ছুঁয়ে গেলো রানুকে। বিশটি বছর আগের দুটি কিশোর কিশোরীর মন আজ একাকার হয়ে গেলো কখন ওদের অজান্তে।
অণুগল্প
ফাঁকা-ফাঁকা
প্রদীপ সেন
দুরাশার পেছন ঘুর ঘুর করে অবশেষে স্থিত হয় ভবেশ। ঝাণ্ডা বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে বুঝল চাকরি হবে না। অবশেষে স্কুলের সামনে একটা দোকান খুলেছে সে। এটা স্বাধীন ব্যবসা। মাথার ওপর দাদা নেই, পেছনে গুঁতো নেই। কিছু পাওয়ার আশায় কুর্নিশ জানানোর হ্যাপা নেই, ফরমাশ তামিলের বালাই নেই, পরমুখাপেক্ষীর অবকাশ নেই। সে আজ স্বনির্ভর। আজ ভাবে আলেয়ার পিছু ছুটে পাঁচ-পাঁচটা বছর নষ্ট করে কী ভুলই না করেছে।
দোকানদারির কাজে পরিশ্রম আছে। সারা দিন গদিতে বসে বসে খদ্দেরদের সেবা করা চাট্টিখানি কথা নয়। তবু সে নিজেই নিজের বস। ধর-কাকা ঠিকই বলেন, লাইগ্যা থাকলে মাইগ্যা খাওন লাগে না রে। ভবেশ বিয়ে করেছে। বছর পঁয়ত্রিশের ভবেশ এক ছেলের বাবা।
ভবেশের খদ্দেরদের সিংহভাগই স্কুল-পড়ুয়া কচিকাঁচা। খাতা, কলম, বিস্কিট, চকোলেট, চিপস্, কেক, আচার - বাচ্চাদের ঝোঁক এ সবের দিকেই। বাচ্চারা নগদে খায়। বড়োদের মতো ধারে জিনিস দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে না।
ভবেশ বাচ্চাদের প্রিয় ভবেশকাকু। কেউ কেউ ওকে আঙ্কেলও ডাকে। ভবেশের মিষ্টি হাসি আর মিষ্টি ব্যবহার ওকে সবার প্রিয়পাত্র করে তুলেছে।
রজত নামে ছেলেটা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা নেই। মা লোকের বাড়িতে কাজ করে। বেচারার চকোলেট কেনার টাকা নেই। দোকানের সামনে এক পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে বাচ্চাগুলো এটা-ওটা কিনছে, খাচ্ছে। দৌড়ে ক্লাসে চলে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভবেশ দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে। পরে দোকানের ভিড় কমে গেলে বারবার ওই ছেলেটার মুখটা চোখে ভেসে ওঠে। বুকের ভেতর কেমন একটা মন-খারাপি অনুভূতি। পরদিন ছেলেটিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে।
চোখেমুখে প্রত্যাশার ছাপ। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে সে। ভবেশ ওর নামধাম জিজ্ঞেস করে হাতে পঞ্চাশ পয়সা দামের একটা চকোলেট দিয়ে বলে, নে রজত, খা। এর বেশি কিছু দিতে তো পারবো না। ওই ক্ষুদ্র দানেই সে যেন সব কিছু পাওয়ার আনন্দে আনন্দিত। চকলেটটা মুখে পুরে ছুট।
এরপর কখন যে এটা নিত্যকার রুটিনে পরিণত হয়ে গেছে ভবেশ বুঝতেই পারেনি। কিন্তু আজ দুদিন রজতের দেখা নেই। খবর নিয়ে জানলো ওর মার কাজটা চলে গেছে। রজতকে নিয়ে ওর মা গ্রামান্তরে চলে গেছে কাজের খোঁজে। হয়তো কাজ পেয়েও গেছে। গদিতে বসা ভবেশের রোজনামচা ঠিক আগের মতোই আছে। তবু চোখ দোকানের সামনে ঈশান কোণে রজতকে খোঁজে! ভিড় আগের মতোই হলেও ভবেশের কাছে ওই জায়গাটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকছে।
অণুগল্প
নীলপদ্ম সরোবর
আবু জাফর সিকদার
হিমাদ্রীর চোখে ঘুম নেই। রাতের পর রাত এভাবেই কেটে যায় নির্ঘুম সময়। পাশে কেউ নেই। থেকেও নেই। রিমান, মানে তার পতিদেবতা, আজ বহু বছর হলো আলাদা বিছানায় থাকে! ছোট ছেলেটিকে রাখতো, সেও কলেজে উঠে যাওয়ার পর বিছানা আলাদা করে দিয়েছে। মেঝ ছেলে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে উঠে গেছে চার বছর আগে! বড় ছেলে বুয়েট পাশ দিয়ে বছর দুই চাকুরীর জন্য ঘুরাঘুরি করে অবশেষে আমেরিকা চলে গেল অনেকটা নিরুপায় হয়ে। ছেলেটা আজ দুবছর পর ফিরছে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বিমান গতকাল ছাড়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় বিলম্ব হয়ে গেল শিডিউল। ছেলে বিদেশ থেকে আসছে এ উত্তেজনায় ও টেনশনে ঘুম একদম ছুটিতে চলে গেছে! তার উপর ফেলে আসা শ্বাসরুদ্ধকর জীবনটাও যেন মাথার ভেতর সেলুলয়েড ফিতার মতো ঘুরপাক দিচ্ছে! রুম্মান, এই বড় ছেলেটির জন্যই, হিমাদ্রীর শেষ পর্যন্ত রিমানের সংসারটা ছেড়ে যেতে পারলো না। স্বামী, সংসার, সম্পর্কের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করতে করতেই শরীরে বাসা বাঁধলো অন্য শরীর! এই সেই নাড়ীছেঁড়া ধন, যাকে আশ্রয় করে হিমাদ্রীর পোতাশ্রয়টি গড়ে উঠেছিলো! ভেবেছিলো দ্বিতীয় সন্তানটা নিলে তার নিজের গভীরের ক্ষতটি আস্তে আস্তে শুকিয়ে উঠবে। কিন্তু না, কষ্টটা তুষের আগুন হয়ে শরীরে লেপ্টে থাকে। এক মরু তৃষ্ণা নিয়ে ঘানিটানা কলুর বলদের মতো কাটিয়ে দিলো যাপনের কত সহস্র দিবা-রজনি। একই পথে তৃতীয়জনও এসে যুক্ত হলো। ছেলে তিনটি বড় হতে থাকে। হিমাদ্রী মায়ের মমতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। কষ্ট ভুলে নিষ্ঠায় মনোনিবেশ করে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে, এখন গর্ব করতে পারে - সে একজন রত্মগর্ভা! আর এদিকে হিমাদ্রীর 'তিনি ' একটি মফস্বল শহরে সরকারি আপিসের চাকুরে! দায়িত্ববান ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে বেশ নাম ডাক। কখনও সপ্তাহান্তে,কখনও দু'সপ্তাহ পর তিনি বৌ বাচ্চাদের কাছে আসতেন। টাকা পয়সা যা দরকার হিসাব করে দিয়ে দেন। এখানেও তিনি যথেষ্ট দায়িত্ববান। এখন হিমাদ্রীর চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তিনি আটান্ন। রিটায়ার্ড করে হজও করে এসেছেন। যথাসম্ভব আল্লাহ বিল্লাহ করেন। এক বাসায় থাকেন, এক হাঁড়ির ভাতও খান। কিন্তু দু'জনার দু'টি পথ দু'দিকে গিয়েছে বেঁকে...একজন পাশের ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, অন্যজন মধ্যরাতের তারা গুনছেন! ষোল বছরের এক কিশোরীকে চৌত্রিশ বছরের এক জন অপরিচিত মানুষের হাত ধরে যে বাড়িতে তুলে আনা হয়েছিলো, দিন কয় যেতে না যেতেই বুঝতে পারলো, সে এই বাড়িতে একজন অগন্তুক মাত্র। তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা; চাহিদা, প্রাপ্তি, দেয়া-নেয়ার এসব রসায়ন ইট-কনক্রিটের ইঞ্জিনিয়ার কখনই বুঝে উঠতে পারেননি! অথবা বুঝার চেষ্টাই হয়তো করেননি! তিনি সেই থেকে পালা করে বিছানায় আসেন। নিজের মতো করে আসেন। নিজের মতো করে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন! হিমাদ্রী বরফ গলে গলে হয়ে উঠে এক নীলপদ্ম সরোবর।